Monday 6 September 2021

পশ্চিম দেশের গপ্পো


প্ল্যানটা কয়েক দিন ধরে সাজাচ্ছিলাম কি করে পকেট ও দিন বাঁচিয়ে কিভাবে দুর্দান্ত একটা ট্রিপ মারা যায়। বন্ধুদের সাথে কথা বলে, ঘোরার গ্রুপে খোঁজ নিয়ে বউয়ের সাথে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক সেরে সিদ্ধান্ত নিলাম সিমুলতলা যাবো। বিহারের, সিমুলতলা একটা সময় বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জায়গা ছিল। ছোটো ছোটো টিলা, তরতির  করে বয়ে চলা নদী ,লাল মাটি দিয়ে সাজানো একটি ছোট্ট জনপদ।
আমরা মোট পাঁচজন চেপে বসলাম রাতের বাগ এক্সপ্রেসে। বাড়ি থেকে আনা রুটি মাংস খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে সটান শুয়ে পড়া গেল। ট্রেনে সবাই ঘুমোতে পারে না, আমার বন্ধুকে দেখলাম দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার বউ আর আমি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে মাঝে মাঝে জেগে কাটিয়েদিলাম। সিমুলতলা নামলাম নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টাবাদে অর্থাৎ ভোর সাড়ে চারটে। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন নামল, অবশ্য তা হাতে গোনা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্টেশন খালি। ভোঁ শব্দ তুলে ট্রেনটাও মিলিয়ে গেল। আমরা আকাশ দেখতে দেখতে স্টেশনের বাইরে এসে অটো ধরলাম। গন্তব্য যশোদা ধাম। আগে থেকে বুকিং করা ছিল। এখানে মাত্র দুটি থাকার জায়গা আছে। বাকি যা আছে তা হয় কারুর বাড়ি অথবা স্কুল সংলগ্ন কিছু অসংলগ্ন ঘর। চলতে চলতে দেখলাম সিমুলতলা বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বহু বাঙালির বাড়ি। কোনটার নাম ঘোষ কুটির, কোনটার নাম পাল ভবন বা স্বাস্থ্য কুটির।


 যশোদা ধামে পৌঁছতেই কেয়ারটেকার বজরঙ্গি আমাদের বিছানা রেডি করে শোবার বন্দোবস্ত করে দিল। তখনও আলো ফু টতে বেশ দেরি, আমরা শরীরটাকে ছেড়ে দিলাম নরম গদিতে। ঘন্টা দুয়েক ঘুম দেবার পর ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত সুরে। ভালু আয়া, ভালু আয়া, কালু-লালু-মলু আয়া, তারহ তারহ সে খিলতা ফুল... মাস্টারজী পড়াচ্ছেন, বজরঙ্গির বাচ্ছা মেয়েটিকে। কতদিন বাদে এইরকম পরিবেশে কাউকে পড়তে এবং পড়াতে দেখলাম। মনটা ভালো হয়ে গেল। চায়ের অর্ডার দিয়ে হাঁটতে বেরোলাম। বাড়িটি বেশ ছোটখাটো প্রাসাদের মত দেখতে। চারিদিকে সেগুন আর শালের রাশি। এত বড় বাগান যে হেঁটে সম্পূর্ণ করা মুশকিল। চা খেয়ে রেডি হতে হতেই গরম গরম লুচি আর বাঁধাকপির তরকারি এসে গেল। খেতে খেতেই অটোকে ফোন করলাম। বেড়াতে যাবার জন্য আমরা প্রস্তুত।

অটোচালক রবি ভাইয়া আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল হলদি ঝরণা দেখাতে। যেতে যেতে সিমুলতলার গ্রামীণ জীবন উপভোগ করলাম। কি সহজ সাধারণ জীবনযাত্রা। মাটির ঘর, ছাগল ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। হলদি ফলসের কাছে আসতেই একগাদা ক্ষুদে গাইড আমাদের ঘিরে ধরল। ওদের সাথে চললাম পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে। যেতে যেতে নীল আকাশের হাতছানি আর হাওয়ার শন-শন শব্দ আমাদের মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। যাইহোক হলদির উৎসস্থলে এসে হতাশ হলাম। একটি সরু গর্ত দিয়ে ঠান্ডা জল বেরিয়ে আসছে, সেটাই পরে চওড়া হয়ে সরু নালার আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ের মাথা থেকে  গ্রাম দেখতে বেশ লাগছিল। আসার সময় ক্ষুদে গাইডদের খুচরোর আবদার মেটাতেই হল। ওখান থেকে চললাম ধারারা ফলস। ফলস না বলে নদী বলাই ভালো। মালভুমি অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হবার ফলে নদীর গতিপথে অসংখ্য বড় বড় পাথর। ফলে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে জায়গাটি। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই ভালো যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু মুশকিল এখানকার গরীব শিশুগুলি। ওদের দেখলে মন ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য। যাইহোক ওদের হাতে কিছু খুচরো দিয়ে আমরা যশোদা ধামের পথ ধরলাম। যশোদা ধামে ফিরে ডিম-ভাত খেয়ে একটু রেস্ট।বিকালে আবার লাট্টু পাহাড় যাবো।






 যশোদা ধাম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে প্রায় ৭০০ ফু ট উঁচুতে লাট্টু পাহাড়। সেখান থেকে সূর্যাস্ত স্বর্গ সুখের সমান। সামনে লাট্টু ভ্যালি, দূরে কয়েকশো বছরের ইতিহাসেরর সাক্ষী ভাঙা রাজবাড়ি। সেই সাথে পাগল করা বসন্তের হাওয়া, সুন্দর একটা গন্ধ, সিমুলতলা ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ পাওনা।সন্ধ্যে নামল, আকাশে তারার খেলা, আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। অন্ধকারের মধ্যে খস খস পায়ের শব্দে পরিবেশটাই হয়ে উঠেছিল অসামান্য।রাতে ফিরে রুটি, দেশি মুরগী আর মহুয়া দিয়ে ডিনার সারলাম। মহুয়া এই প্রথম খেলাম। একটা বুনোগন্ধ। তবে গ্রাম্য ছোঁ য়া আছে। চাটগুলো মনমোহিনী থাকায় কিছুটা মহুয়া গলাধকরণ করতে পেরেছিলাম। পরের দিনই ট্রেন। তাই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রাখলাম।পরেরদিন সকালে উঠে চান-চা পর্বসেরে বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় প্রাণভরে যশোদা ধামের নির্যাসটুকু গ্রহণ করলাম। কেয়ারটেকার বজরঙ্গী ভাইয়ের সাথে বেশ কিছু সেলফি নিলাম। অটো এসে হর্ণ দিতেই বেরিয়ে পড়লাম। দূরে পাহাড় দেখতে এগিযে় চললাম স্টেশান এর দিকে.... আবার আসবো,কথা দিলাম...


2 comments:

  1. ঝরঝরে ভাষা এবং মসৃণ গল্পের আঙ্গিকে সুখপাঠ্য একটি ভ্রমণকাহিনি।

    ReplyDelete

নষ্ট চোখ

  রোজ বেচুদার গোলার পাশ দিয়ে যাচ্ছি  আর দাঁড়িয়ে পড়ছি। একটু একটু করে গড়ে উঠছে  মা...  মায়ের হাত পা চোখ...  আমি দেখছি তিলোত্তমার হাত পা ...