ঠান্ডা!!ধুর কোথায় ঠান্ডা?ব্যান্ডেল থেকে যখন ট্রেন এ উঠলাম তখন এই কথাই ভাবছিলাম।ট্রেন ছাড়তেই শুরু হল মুখ চলা।ডিম বাদাম চিপস...এখন তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে । ধানক্ষেতে চুপিসারে নামে অন্ধকার।অন্ধকারের মাঝে মাঝে আলোগুলো অদ্ভুত মায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । রাত্রিকালীন যাত্রাতে সাইড লোয়ার সিটটার একটা অন্যরকম টান আছে। কোথায় কোথায় যেন হারিয়ে যায় মনটা । পাহাড়ের কথা বলতে বসলে কি যে বলতে থাকি ...গান গল্প করতে করতে সামান্য ঘুম এ ঢুলে মাঝরাতে নামলাম এনজেপি। ও আপনাদের তো বলাই হয়নি এবারে আমাদের গন্তব্য লেপচাজগৎ।ঘুমের কাছে ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম ।
চা পর্ব সেরে গাড়ি ঠিক করে চললাম লেপচাজগৎ।সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা দেখতে দেখতে মাঝে থামলাম চা খেতে। অচেনা জয়গার নাম জানিনা। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডাটা মালুম হল। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নামলাম ।গরম চা আর কুকিস খেয়ে আবার পাহাড়ি রাস্তায় উঠা শুরু।পাহাড়ের একটা আলাদা টান আছে , আর দার্জিলিং ? সে তো বলে বোঝানো যাবে না । প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে থাকে আলাদা সৌন্দর্য । কুয়াশা গুলো গাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে চোখে মুখে চুমু খেতে ব্যস্ত ।
ঘুম থেকে যে রাস্তাটা সন্দক্ফুর দিকে চলে গেছে সেই রাস্তায় 11কিমি গেলেই লেপচাজগৎ। আগে থেকে ঠিক করে রাখা লক্ষ্মী হোম স্টে এবারে আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা।পৌঁছেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানলো হোম স্টের মালিক টিকারাম তামাঙ্গ।পাহাড়ের কোলে এত সুন্দর করে সাজানো একটা বাড়ি দেখলেই মন ভরে যায়।সুন্দর এক কাপ চা আর সাথে বিস্কুট আসতেই পুরো ব্যাপার জমে ক্ষীর।
ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে আলাপ হয়ে গেল পোলার এর সাথে। হোম স্টের কুকুর। তার সঙ্গী ছোট্ট বিড়ালছানা টির নাম পপুলার। অতি মিষ্টি।
আমরা চান টান করে বেড়িয়ে পরলাম লেপচা ভ্রমণ এ। চারিদিকে পাইন গাছের সারি আর মাঝে পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে রাস্তা।আমরা স্থানীয় একটি ছেলের সাথে গেলাম ভিউ পয়েন্ট। পাইন বন পেরিয়ে বেশ কিছুটা উপর এ উঠে একটি সমতল জায়গা যদিও সেটাও কোনো একটি পাহাড়ের মাথা।কষ্ট করে উঠে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত কাছে এত বড় কাঞ্চনজঙ্ঘা!!!!এতবার উত্তরবঙ্গ এসেছি কিন্তু এত সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা কোনোদিন দেখিনি। আমরা কয়েক মিনিট নির্বাক। ঘোর কাটতেই শুরু হোলো ছবি তোলা। প্রচন্ড ঠান্ডা কে অসম্ভব আদর করেই আমরা ছবি তুলতে থাকলাম।অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে কখন যে ঘন্টা তিন কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি ।
দুপুরে ভাত আর ডিম দিয়ে সারলাম আহার। খুব আদর করে করা রান্না গুলো আমরা চেটে পুটে সাবার করলাম । দুপুরে হালকা রোদে একটু আড্ডা মারতে মারতেই বিকাল । আমরা টিকারাম ভাইয়ার সাথে গেলাম সুখিয়া বাজার। নানা জিনিস। সোয়েটার জ্যাকেট কেক জুতা সারি সারি সাজানো। বেশ কিছু কেনাকাটাও করলাম। ফেরার সময় সূর্য বিদায় নিয়েছে। বুঝতে পারলাম ঠান্ডা আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাস করছে।
ফিরে এসে জমিয়ে চা নিয়ে বসে হোম স্টের ছোট মালিক যুবরাজ এর গান শুনতে লাগলাম। ও নতুন গিটার বাজানো শিখছে। নেপালি গান টা দারুন গায় । সাথে অরিজিৎ । রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা। এতটা ঠান্ডা আগে কখনও পাইনি । পরদিন জেনেছিলাম রাতে 1ডিগ্রি ছিল।
মাঝরাতে পোলার এর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছু বুঝতে পারলাম না। ভয় ও লাগলো। চুপচাপ কম্বল এর তলায় সেঁধিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে জানলাম একটি কুকুর কে ধরে নিয়ে গেছে চিতা। এখানে এটা প্রায় হয়।
দ্বিতীয় দিন আমরা ঘুম মনেষ্ট্রী আর দার্জিলিং গেলাম। দার্জিলিং নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।তবে দার্জিলিং আমার অন্যতম প্রেম । সেই কলেজ জীবনে অঞ্জন দত্তর গানে এই পাহাড়ি শহরটাকে জেনেছিলাম । না দেখেই প্রেমে পড়ি । দেখার পরে প্রেমটা দ্বিগুন হয়ে যায় । জলাপাহাড় , কিউরিও শপ , কেভেন্টর্স আমার মনকে আবিষ্ট করে রাখে । সারাদিন যদি আমাকে শাস্তি দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় কেভেন্টর্স এর ছাদে তাহলে আমার থেকে আনন্দ কেউ পাবেনা ।কেভেন্টর্স এর কফি ...উউউম , ভাষা নেই , সাথে সসেজ । কাঞ্চনজংঘা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাই আমি ।
পুরনো ঘুম মনেষ্ট্রী অনেকেই যান না।ঘুম স্টেশান এর পাশেই। একটা গালি দিয়ে সামান্য ঢুকেই।খুব শান্ত ,একটি জায়গা । বেশ কিছুটা সময় কাটালাম ।
লেপচায় ফিরি। লেপচাজগৎ খুব মিস্টি একটা পাহাড়ি গ্রাম।নির্জনতা এই গ্রামের মূল সম্পদ । পাহাড়ি শিশুগুলো মায়ের পিঠে চেপে কি সুন্দর নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের নিচে। কেউ একমনে গাড়ি পরিস্কার করছে। কেউ ফুটবল এ ব্যস্ত। ২টো কি ৩টে দোকান। সব মিলিয়ে একটা সুন্দর প্রকৃতি। আর সব থেকে বড় প্রাপ্তি হাত বাড়লেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখ জুড়ানো কাঞ্চনজঙ্ঘা।
বিদায়কালে চোখে জল এসেছিল , কিন্তু অঞ্জনবাবু বলেছেন বয়েসের সাথে সাথে কমে যায় চোখের জল ...তাই চাইলেও পারিনা কাঁদতে , চোখের জল লুকিয়েই বিদায় জানলাম লেপচাজগৎ কে , আবার কোন একদিন আসবো এই বলে ...
একটি মানবিক আবেদন, একটু দেখবেন...