লেখা বা গালাগাল দিতে ইচ্ছে হলে-
13jachhetai@gmail.com
9339649976
মুখ দিয়ে চড়া মদের গন্ধ। চার অক্ষর গালাগাল দিতে দিতে মাতাল ঝন্টি আজ বাড়ি ফিরছে। এটা নতুন না। রোজ ফেরে। বাড়ি গিয়ে ডাল ভাত খাবে বউ এর আনা। মারতেও বাকি রাখেনা। মুখ বুজে সহ্য করে বেচারি।
আগামী কাল ছুটি। রাতেই মাংস কিনে বাড়ি ফিরলো অর্ণব। কাল বেশ আয়েশ করে খাওয়া যাবে। কিগো শুনছো, মাংস টা ধুয়ে মেরিনেট করে রাখোনা। কাল ছুটি, জমিয়ে মাংস...
প্রিলিটা কবে হয়েছে, মেন কবে হবে জানা নেই সুমিতের। টিউশনি গুলোও বন্ধ। অনলাইন একটা ক্লাস করাচ্ছে, সপ্তাহে ৩০০ টাকা।বাবার হাঁপানিটা বাড়ছে। ওদিকে দিয়ার বয়সও বাড়ছে, ও আর কয়েকদিন দেখবে, তারপর...
কৃষকদের আলুর দাম কেন কম দেওয়া হচ্ছে সেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছিলো সিতাংশু। মারতে মারতে আরও তিন জনের সাথে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছিলো থানায়। বিধবা মায়ের কাতর ডাকে সাড়া দেননি দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার নির্মল বাবু। মাওবাদী ধরতে পারলে প্রমোশন এ সুবিধা হয়।
ও, কদিন বাদেই তো আবার ১৫ ই আগস্ট। কতগুলো ঘটনা মনে পড়ে গেলো...
কবিতা
বিষয় স্বাধীনতা
পৃথিবী তুমি সেরে যাও
তাসফীর ইসলাম (ইমরান)
উড়ে যায় স্বাধীন দু শালিক
শপিংমল, রাস্তাঘাট রোজ একা
মরে যায় আরও একটা দিন
ব্যালকনিতে কফিকাপ রাখা।
দেওয়ালের গায়ে জমে কথা
বাতাসে শুকনো নীরবতা
এ শহর ঘুমিয়ে আছে তাও
পৃথিবী, তুমি সেরে যাও ।
ভরে যায় লেখায়, এপিটাফ
সিঁড়ির পাশে ছায়ারা কথা বলে
ভেঙে যায় আরও, পোর্সেলিন
হেডলাইনে মৃত্যু বেড়ে চলে
দেওয়ালের গায়ে জমে কথা
বাতাসে শুকনো নীরবতা
এ শহর ঘুমিয়ে আছে।
স্বাধীনতা'র হাইকু
সৌভিক সেনগুপ্ত
(১)
পদ্ম পাতায়
পতাকা রঙ জল
গা ভেজায়।
(২)
শহীদ বেদী
সুরভি বেড়ি পায়ে
চোখে আজাদী।
(৩)
মুক্তির ঝড়ে
খাঁচা আছাড় খায়
খুঁড়িয়ে ওড়ে।
স্বাধীনতা(শুধুই মুখে)
সত্যই কি স্বাধীনতা লভেছে জনজাতি
নিজের অধীন হয়েছে কি কোনো কালে?
সত্যই কি দিতে পেরেছে পরাধীনতার আহুতি
তারা কি কোনোদিন গেছে গন্ডি ছেড়ে?
সত্যই কি এরা মানুষের নামধারী
তারা কি হাত বাড়িয়েছে কারো হাতে?
সত্যই কি তারা কুপ্রথার দিয়েছে তিলাঞ্জলি
ছোঁয়াছুঁয়ি,জাত ধর্ম থেকে সরে?
সত্যই কি তাদের নেই কোনো বাঁধাবাঁধি
তারা তো ওড়েনি মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে!
সত্যই কি স্বাধীনতা লভেছে জনজাতি,
নিজের অধীন হয়নি তো কোনো কালে !!
মুক্তি
অর্চিতা সেন
মুক্তি কারো আকাশ ছোঁয়ায়,
মুক্তি কারো মাঠের আলে-
মুক্তি কারো মেঘ হয়ে যায়,
স্বপ্ন দেখায় ঘুমের ঘোরে।
মুক্তি কারো কাগজ কলম,
মুক্তি কারো গানের সুরে,
মুক্তি কারো মেললো ডানা
ঘর হতে দেশ দেশান্তরে।
মুক্তি কারো উল্টো স্রোতে-
জীবন টা কে রাখলো বাজী,
মুক্তি কারো ফিরলো দেশে-
মুড়িয়ে শরীর তেরঙ্গা তে।
মুক্তি কারো শাড়ির ভাঁজে,
বাবা মা ভাই বোনের স্নেহ,
মুক্তি কারো বাঁচিয়ে রাখায়-
কেউ মরণে মুক্তি খোঁজে।
মুক্তি কারো একলা চলায়,
মুক্তি কারো সঙ্গী হওয়ায়,
বাঁধন ছেঁড়ায় মুক্তি কারো-
মুক্তি কারো আগলে রাখায়।
হিংসা দ্বেষ সরিয়ে দিয়ে-
মুক্তি ফিরুক ভালোবাসায়,
স্বপ্ন গুলো বাঁচিয়ে রাখি,
ইচ্ছে নামের মুক্ত হাওয়ায়।
স্বধীনতার ইতিকথা
রিঙ্কু ঘোষ
স্বাধীনতা টুবুর কাছে শুধুই খেলনা-বাটি,
আয়েষার কাছে স্বাধীনতা বোরখা থেকে ছুটি ।
বাবুর কাছে স্বাধীনতা, ব্যাট- বল আর জ্যাকেট,
রামুর কাছে তখন সেটা দিনের শেষে পকেট।
বাবুসোনার মুখ ভার এমন খাবার পছন্দ নয়-
খাবারে কামড় দিয়ে রামু ভাবে একেই বুঝি স্বর্গ কয়।
খসে পড়া দেওয়ালটার স্বাধীনতা বাঁচার লড়াই ,
বহুতল বাড়িটায় আত্মহনন- কুছ পরোয়া নাই ।
আমার স্বাধীনতায় নাম লিখেছে একাকীত্ব, বৃদ্ধাশ্রম ।
'ক্ষুদিরাম- প্রফুল্ল ' করলেন বুঝি সব পন্ডশ্রম।
অতীত ভুলে- ভবিষ্যতের ধুয়ো তুলে ,
চলেছি সবাই বর্তমানকে অতলে ঠেলে -
আলাদিনের প্রদীপখানি হাতে যদি আসে-
সোনার বাংলা গড়ে তোলা কে আটকাবে !
স্বাধীন দেশটা বাঁচুক
সমীর ব্যানার্জী
নাই বা উড়ল রঙিন ফানুস,
ঠগের দেওয়া মিথ্যে আশা ৷
প্রয়োজন নেই 'এল ডোরাডো-র,
মায়ের কোল খালি করে
হত্যাকারীর স্বপ্নের ভোর ৷
আগে স্বাধীন দেশটা বাঁচুক !
মন্দ ভালোর লড়াই থাকুক,
নানা মতের অমিল থাকুক,
স্বাধীন মতের কলম থাকুক,
ভোর রাত্রের আজান থাকুক,
সন্ধ্যা শাঁখের আওয়াজ থাকুক ৷
সাথে এই দেশটা বাঁচুক !
আগে এই দেশটা বাঁচুক....
জেনে রাখো মিলিয়ে যাবে
দগদগে সব নতুন ক্ষত,
মনের কোনে গুমরে ওঠা
দলা পাকানো কান্না যত,
শুধু সনাতনী দেশটা বাঁচুক ৷
আয় না সবাই হাত মেলা...
সপ্তমেতে তুলে গলা,
বলি, এবার তোদের পালা !
ফিরিয়ে দে মোর দেশটাকে
আমার নাড়ির টান টাকে,
ভালবাসার ঠাঁই টাকে ৷
ভালবাসার দেশটা বাঁচুক,
মুক্ত মনের স্বপ্ন বাঁচুক,
আঠারো-র কন্ঠ বাঁচুক,
ভালবাসার ঠাঁই টা বাঁচূক,
মাঠের সোনা ধানটা বাঁচুক,
রাম রহিমের প্রেমটা বাঁচুক ৷
আমার চেনা দেশটা বাঁচুক....
স্বাধীনতার স্বাদ টা বাঁচুক ।
স্বাধীনতা
প্রিয়াঙ্কা দাস
স্বাধীনতা শব্দটা আজও
কবিতা গল্পে নাটকের পাতায় বিরাজমান।
প্রশ্ন ওঠে নারী মননে বারবার...
আমরা সত্যি কি স্বাধীন???
জন্ম থেকে মরণ
মেয়ে জীবনতো শিকলের বাঁধন ।
নিজস্বী শব্দটা মনে হয়
জীবনের অন্তিম ধাঁধা।
পুরুষ সমাজের
অন্যায় চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে
জেহাদ ঘোষণা করলে
নারীর কপালে জোটে
নির্যাতনের চরম থাবা।
আমি তাই নির্দ্বিধায় বলতে চাই
পুরুষ সমাজ তোমাদেরই
এই স্বাধীনতা মুবারক।
রাষ্ট্রের কাছে
সোনালী ঘোষ
এ জন্মের গায়ে মুছে দিয়েছি, স্বাধীনতা
এখন আজান ভেসে ভেসে আসে
কখনো শাঁখের আওয়াজ
প্রার্থনা করতে ভুলে গেছি
কি চাইব, কি ই বা আছে চাওয়ার
কেউ ই তার ঠিকানা বলে যায়নি
একটি আশ্রয়যোগ্য ভরসা ও দেয় নি
তাই আমি ই সেধে সন্ন্যাস চেয়েছি শুধু ...
স্বাধীনতা
দেবাশিস রায়
স্বাধীনতা নামে ফুলেদের যৌনতায়
স্বাধীনতা নামে প্রশ্রয়ে মৌনতায় ।
স্বাধীনতা হোক প্যাশনের এক ক্রেজ
স্বাধীনতা হোক রামকিঙ্কর বেইজ ।
স্বাধীনতা মানে রবি ঠাকুরের গান
স্বাধীনতা মানে "আরো আরো দাও প্রাণ "।
স্বাধীনতা মানে মানব আর মানবী...
যুগলবন্দি, ক্লোজশটে আঁকা ছবি!
স্বাধীনতা মানে ন্যাংটো ছেলের ডাক
ওরাও দুবেলা পেট ভরে খেতে পাক!
স্বাধীনতা মানে প্রখর চৈত্র,শ্রাবণের বেখেয়াল
স্বাধীনতা মানে বসন্ত-ঘুড়ি পেটকাটি,চাঁদিয়াল!
স্বাধীন হলাম
স্বর্ণালী দত্ত
একটা কালির দাগে যে স্বাধীনতা দেশে এলো তাতে সত্যিই
স্বাধীন হলাম!
নিজেদের অস্তিত্বকে হাত বদলের খেলায় বন্ধক রেখে স্বাধীন হলাম।
সর্বকালের পরাধীন মেয়েদের আরও স্বাধীনভাবে ভোগ করা গেল
অগ্নিসাক্ষী করেও কি সহজে অগ্নিদগ্ধ করা গেল
প্রেমের রসায়ন কষতে চেয়ে অ্যাসিডের গুণমান পরীক্ষা করা গেল
কন্যাসন্তান শুনে সংসারকে শ্রীহীন করাও কত সহজ হয়েছে আজ
ভদ্রলোকের ঘরের মেয়ের পায়ে আজও শিকলের শব্দ শুনতে পাই
শিক্ষার নামে মেয়েদের এনাটমির স্বাদ পাওয়া তো ঘরোয়া ব্যাপার!
ইন্দ্রীয়গুলোকে সজাক রেখেও রক্ষে পেল না কত চাকরিওয়ালি
সংবিধান তো এখনও সংরক্ষিত রেখেছে শতাংশের মাপকাঠিতে।
মোটের ওপর এইভাবেই স্বাধীন হয়েছি আমরা
শুধু মনগুলোই পাখা মেলতে পারলনা আকাশে।
দুশো বছর আর নয়
হাজার বছরের যুদ্ধের ইতিহাস
রক্তে তোলে হিল্লোল
অশান্তির ঝড় মনে।
দুশো বছরের পরাধীনতার ইতিহাস
রক্তে তোলে হিল্লোল
অশান্তির ঝড় মনে ।
পাঠ্যপুস্তকে বীরত্বের লড়াই
স্বাধীনতার জন্য লড়াই
জীবন-মরণ প্রাণপণ লড়াই
রক্তে তোলে হিল্লোল ।
শহিদের রক্তে লেখা হয় রক্তাক্ত ইতিহাস ।
অন্তরাত্মা উথাল পাথাল ঝড়ের আবেগে ভাসে
অভিসম্পাতের অগ্নিবর্ষণে সাম্রাজ্যবাদের
মুন্ডুপাত করি মুহুর্মূহু
তবুও শান্তি নেই মনে ।
টলমল স্বাধীনতা দেউলিয়ার
নিলামে বাজার দরে....
স্বাধীনতা দেউলিয়া.....
দুশো বছর---
কম সময় তো নয়
ইট-কাঠ-পাথরেও পরাধীনতার অশ্রু
কি যাতনা কি কষ্ট
রক্ত ঝরে হৃদয়ে......
আর নয় কখনও নয়
আর নয় অবমাননার ইতিহাসের
পুনরাবৃত্তি---
যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
চল যাই প্রাণপণে সামলে রাখি
স্বাধীনতা মূলধন
করি দৃঢ় পণ---
দুশো বছর আর নয়
দুশো বছরের পরাধীনতা
আর নয়.....
স্বাধীনতার মোহর
শুভমিতা বিশ্বাস
সোনা দিয়ে বাঁধানো রক্তমাখা হাত-
শস্যের আসনে বসে
"স্বাধীনতার মোহর"দান করে
কালো পিঠের কাঁধে বসে, রাজা ইট পাথর ছুড়ে দেয়,
ক্ষুধার্ত সমুদ্রে।
সরু সরু পায়ে একদল কঙ্কালের বক,
কাগজ চিবিয়ে মরা নদীর দিকে চেয়ে থাকে,,,
অন্য ভাবনা
গল্প হলেও সত্যি
সন্দীপ রুদ্র
প্রতিটা পরাজয় প্রতিটা প্রত্যাখানের মধ্যে পেয়েছি স্বাধীনতা । প্রতিটা না হওয়া প্রতিটা না পাওয়ার পেয়েছি স্বাধীনতা । প্রতিটা হেড়ে যাওয়া প্রতিটা হারিয়ে ফেলার মধ্যে পেয়েছি স্বাধীনতা । যতবার ব্যার্থ হয়েছি ততবার স্বাধীন হয়েছি .....
মূল্যহীন অর্থহীন অর্বাচীন একটা শব্দ নিয়ে শব্দের জলবোনার থেকে , শুরের সাথে নর্দমার পাঁক নিয়ে খেলা করা অনেকে সুখের সময় কাটানো ।
তবু জোর করে স্বাধীনতা শব্দ টাকে যখন চাপিয়ে বুঝিয়ে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন না মানাটা , শিক্ষার বিরুদ্ধে । তাই হারমেনে নিয়ে লিখছি । কারণ হেরে যাওয়ার মধ্যে আমি যে অনুভূতির গন্ধ পাই , আভিধানিক অর্থে তাই " স্বাধীন " নামক শব্দে লিপিবদ্ধ আমার মাতৃ ভাষায় ।
একটা জয় একটা পাওয়া , আমাকে বন্দী করে দিত । বিশ্বাস করুন প্রতিটা হারের মধ্যে , আমি অসম্ভব সুখ পাই । স্বাধীনতা তো , জেতা । কিছু পাওয়া । তাই না ? পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো টাই যখন জীবন , তখন স্বাধীনতা বলতে যা বোঝেন , বোঝানো হয় সেই অনুভব টা কোথায় ?
আপনি কোনোদিন কখনো কোনোভাবে কোনো অর্থে স্বাধীন হতে পারবেননা ।
মৃত্যু তেও না ( হয়তো ) ।
স্বাধীনতা অর্থে , স্বাধীনতা হলো একটা খারাপ আপোষ থেকে আরেকটু ভালো আপোষের দিকে যাওয়া । আর কিচ্ছু না ......
এই লেখার মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজতে যাবেননা , কারণ যা আমার উপলব্ধি তে অর্থহীন সেটা নিয়ে অর্থবহ লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
১৫ই আগস্ট
দেবাশিস শুভ্র ঘোষ
সিজার হয়েছে।জ্ঞান ফিরছে। লছমির মনে পড়ছে...
দুপুর গড়াতেই ব্যথা উঠলো। ভ্যানে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শাশুড়ি পই পই করে বললেন,পর পর তিনটে মেয়ের জন্ম দিয়েছো।এবার যেন বংশটা রক্ষে হয়। এবারও মেয়ের জন্ম দিলে মা,মেয়ে দুটোকেই গলা টিপে ...
'মা গো!' এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় একটা গর্তে ভ্যানটা পড়তেই আর্ত-স্বরটা বেরিয়ে এসেছিলো লছমির গলা থেকে।
এরমধ্যে দু'দিন চলে গেছে। লছমি বা তার বাচ্চাকে দেখতে কেউ আসে নি।লছমিদের গ্রামেরই এক মেয়ে এখানে কাজ করে। তার মুখেই লছমি শুনেছে,সিজার হওয়া অবধি অনেকে ছিলো।কিন্তু বাচ্চা জন্মানোর পরে সবাই হাওয়া।
লছমির ভয় হ'তে থাকে।তবে কি আর তাকে শ্বশুর-ঘরে নেবে না?তাহলে লছমি কোথায় যাবে?বাপটাও তো গত বছর মাঠের থেকে গরু আনতে গিয়ে বাজ পড়ে অকালে চলে গেল!
গ্রামের ঐ মেয়েটিকে লছমি অনেক করে বলল,তার স্বামী যেন একবার আসে।পাঁচ দিনের দিন ওর স্বামী বিট্টু এলো। মুখ থমথমে। স্বামীর হাঁটু ধরে লছমি খুব কান্নাকাটি করলো।তাতে বিট্টুর মন গললো কিনা জানি না। ছ'দিনের দিন লছমি শ্বশুর-ঘরে এলো। কেউ কথা বলে না। ওর আগের মেয়েদের ননদ নিয়ে গেছে।
সেদিন গনগনে রাগে লছমির কোল থেকে বাচ্চাটা কেড়ে নিতে যান শাশুড়ি। বলেন,ওকে শেষ করবোই। লছমি প্রাণপণ শক্তিতে মেয়েকে আরো বুকে চেপে প্রতিরোধ গড়তে চাইলো।শাশুড়ির ধাক্কায় ট্রাঙ্কের কোণায় লেগে কানের কিছুটা ওপরে ফেটে রক্ত গড়ালো।তবু বাচ্চাকে ছাড়লো না। চিৎকার করতে লাগলো,বাঁচাও বাঁচাও!
বস্তিবাড়ির পাশের ঘরের দজ্জাল-পিসি এসে অনেক কষ্টে শাশুড়িকে ঘরের বাইরে টেনে আনে।তার আগেই অবশ্য একপ্রস্থ চুলোচুলি হয়ে গেছে দুজনের।
তারপর থেকে লছমি আর রাতে বা দিনে ঘুমোয় না। আতঙ্কে কাঠ হয়ে থাকে।যদি ওর মেয়েকে ওরা মেরে ফেলে!
কয়েকদিন এভাবে চলার পর সেদিন ভোরের দিকে লছমি ঘুমিয়ে পড়েছিলো।ঘুম ভাঙতেই দেখলো চৌকি ফাঁকা। এখনও না সেরে ওঠা শরীরটা নিয়ে শিশুটির খোঁজে পাগলের মতো বাইরে বেরোতে গেলো।বাইরে থেকে দরজা বন্ধ ।দরজায় ধাক্কা-ধাক্কি করতে করতে কান্নায় ভেঙে ভেঙে মেঝেতেই বসে পড়লো লছমি।
তখন কটা বাজে,ন'টা কি দশটা হবে। সেই দজ্জাল-পিসি দরজা খুলে বললো,পালা,লছমি পালা।তোর মেয়েকে ওরা দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।তোকেও হয়তো মেরে ফেলবে!
লছমি কোথায় যাবে?ওর মাথা ঝিমঝিম করে। কিছু ভাবতে পারে না। দিন-রাত-জীবন-মৃত্যু যেন একাকার হয়ে যেতে থাকে। বইতে থাকে বিপন্নতার স্রোত। ও জানে না,হয়তো জানতেও চায় না,আজকে কোন দিন,কী তার তাৎপর্য!!
লালকেল্লায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সগৌরবে উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা। আজ ১৫ই আগস্ট!
স্বাধীনতা
অরিজিৎ পাল
স্বাধীনতা মানে কি ? সে কি শুধুই এক অলীক স্বপ্ন ? শোষকের রাজ্যপাটে শোষিতের চোখে সে কি নিছকই এক মরীচিকা ? তাই বা কি ক'রে হয় ? স্বাধীনতা তো আমরা পেয়েছি৷ অর্জন করেছি কিনা তা জানি-না অবশ্য৷
ভাবতে চাই ... কখন এসেছিল সেই স্বাধীনতা ? মধ্যরাত্রে , রতিক্লান্ত নারী-পুরুষ যখন উষ্ণ আলিঙ্গনে সুখনিদ্রায় ছিল বিভোর ... তখন কি স্বাধীনতার মানে বুঝতে পেরেছিলাম আমরা ?
পরাধীনতা একটা অসুখ৷ তবু ... অসুখ সারলেই কি সবসময় সুখী হওয়া যায় ? স্বাধীনতা একধরণের নিরাকার সুখ৷
জল , আলো , বাতাসের মতোই বেঁচে থাকার মৌলিক রসদ হল স্বাধীনতা৷ "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়"!! আবার ... স্বাধীনতা মানে শুধুই দেশের শাসন-ব্যবস্থায় বৈদেশিক শৃঙ্খলমুক্তি নয়৷ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাওয়ার অধিকার , মুক্ত-চিন্তায় সুস্থ ভাব-প্রকাশের অঙ্গীকার — এক কথায় আর্থ-সামাজিক-মানসিক উত্তরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে স্বাধীনতার প্রকৃত সার্থকতা৷
স্বাধীনতা মানে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ঘৃণা করার স্পর্ধা৷
আধুনিক নগর-সভ্যতা বিচলিত ক'রে মাঝে-মাঝে ... স্বাধীনতা কি শরীর-সর্বস্ব ? তবু ভালো ... জটিল মন , পঙ্কিল চিন্তা-ভাবনার ঘোলা স্রোতেও পাঁকাল মাছের মতই সাবলীল৷ তাই , জনবহুল রাজপথে দু-জোড়া চোখের চকিত ভাব-বিনিময়ের মধ্যেও যেন খুঁজে পাই স্বাধীনতার নীরব , অমোঘ উপস্থিতি৷
স্বাধীন হ'য়ে , স্বাধীনভাবে অন্যের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বোধটুকু স্বীকার করতে পারার মধ্যে যে এক-টুকরো আত্মবিশ্বাস — হয়তো বা সেটাই আসল স্বাধীনতা৷
অশ্রু ঝরা দিন
মৃন্ময় ভট্টাচার্য্য
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ঠিক রাত ১২টায় যখন বিশ্ব ঘুমিয়ে আছে, তখন জেগে উঠল এক স্বাধীন দেশ "ভারতবর্ষ" । বৃটিশের মহানুভবতায় ভারত পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত হল । গান্ধী নামক এক মহাত্মার অহিংস আন্দোলনে খুশী হয়ে, তাঁর মনোনীত অনুচরের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে, বৃটিশ ফিরে গেল তাদের প্রিয় মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে । ভারতবাসীকে তা জানানো ও মানানো হল । তখন থেকে ১৫ আগষ্ট মানেই গর্বের "স্বাধীনতা দিবস" !
বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে, ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ ছিল শুধুমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন, স্বাধীনতা কেন হবে ? ওই দিনই দেশের সিংহাসনে নতুনরূপে বসেছিলেন লর্ড মাউনব্যটেন গভর্নর জেনারেলের ছদ্মবেশে । স্থল,নৌ ও বিমান বাহিনীর তিন প্রধানই দীর্ঘদিন ধরে রাখা হয়েছিল বৃটিশদের । ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সকল গোপন তথ্য পাঠানো হতো ইংল্যান্ডের গোয়েন্দা বিভাগ এম. ফাইব (M5) এর কাছে, নেতাজী ও অন্যান্য বৃটিশ বিরোধীদের খোঁজ খবরের জন্য । তবুও ১৫ই আগষ্ট নাকি স্বাধীনতা দিবস!
ইংরেজরা ভয় পেয়েছিল দেশব্যাপী সৈন্য বিদ্রোহ র জন্য, ১৯৪৬ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে নৌ বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, তারপর একে একে স্থল ও বিমান বাহিনী বিদ্রোহে যোগ দেয় । মাত্র ৮০,০০০ ( আশি হাজার ) সাদা চামড়ার নিষ্ঠুর শাসক যখন তের লাখ ভারতীয় সৈনিকদের বিদ্রোহে প্রাণভয়ে কাতর, তখনই ইংরাজদের বাঁচাতে দেশীয় নেতৃত্ব গান্ধী, নেহেরু, জিন্না, প্যাটেল সেই বিদ্রোহ দমনে মূখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । পুরস্কার স্বরূপ ঐ তথাকথিত দেশপ্রেমিক নেতারা দেশমাত্রিকাকে টুকরো করে নিজেদের আখের গোছাতে সক্রিয় । জনগণকে শেখানো হলো এটাই স্বাধীনতা, গাওয়া হল অহিংসার গান ।
ক্ষুদিরাম, বাঘাযতিন, বিনয়-বাদল-দীনেশ, সূর্য সেন, ভগৎ সিং সহ হাজার হাজার যুবক, যারা দেশকে ভালোবেসে জীবন দিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের ষাট হাজারের মধ্যে ছাব্বিশ হাজারের জীবনদান মূল্য পেল না ইতিহাসের পাতায় । যে সর্বত্যাগী বীরের ভয়ে ইংরেজ ভারত ছাড়তে বাধ্য হল, তাকে ছোটো করে দেখিয়ে, শুধু অহিংসার দ্বারা স্বাধীনতা প্রাপ্তির মিথ্যা প্রচার মেনে কি নেওয়া যায়?
ইংরেজ যেভাবে সিরাজোদৌলার পর বাংলার মসনদে পুতুল সম্রাট মিরজাফরকে বসিয়ে ছিল, তারপর হিংস্র নখ, দাঁতে আঁকড়ে দখল করেছিল তখনকার দিনে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ভারতবর্ষের সিংহাসন । ঠিক সেভাবেই সব ধন সম্পদ লুঠে, দেশটাকে ছিবড়ে করে, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সুকৌশলে সিংহাসন বসিয়ে গেল তাদেরই হাতে গড়া নতুন একদল পুতুলদের, ঠিক যেন তারা ঐ মিরজাফরের উত্তরাধিকারী ।
সেই অবহেলিত, নাম মুছে দেওয়া দেশপ্রেমিকদের জন্য আজও আমার অশ্রু ঝরে, তোমরা স্বাধীনতার নামে হুল্লোড়ে মাতো, আমি একান্তে স্মরণ করি তাঁদের, যাদের তোমরা মনে রাখোনি ।
মুক্তির কারাগারে
'নমামি গঙ্গে…'
কোলচা ভরা জল গঙ্গায় ঢেলে দু হাতের চেটো এক করে কপালে ঠেকাল সমরেশ। আজকের নয় এ তার বহুদিনের অভ্যাস। আস্তে আস্তে চোখ মেলার পর সিঁড়িতে রাখা বালতিটা এগিয়ে নিয়ে সেটা ভরে নিল। সরকারি চাকুরে সমরেশ।বয়স তেত্রিশ। বিয়ে করেনি। মা বাবা বয়স্ক আর অসুস্থ, তাই নিজের কাজটা নিজে সামলানোও যে একটা আর্ট এবং সেই আর্ট রপ্ত করাও যে খুব জরুরি সেটা সমরেশ খুব কম বয়সেই বুঝে গেছিল। আজ অফিস নেই।১৫ই আগস্ট। তাও প্রতিদিনের তার ভোরবেলার গঙ্গাস্নানে ছেদ পড়েনি। ভোর চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ ঘাট সাধারণত ফাঁকাই থাকে। জেলেরা থাকে কোনো কোনো দিন , কোনো দিন আবার চলে যায়। তাই যখন সামরেশের চোখ পড়ল ঘাটের সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপে বসে থাকা একটা মাঝ-বয়েসী লোকের ওপর এবং সে অপরিচিত, এ অঞ্চলের প্রায় সব লোকেদেরই সমরেশের চেনা যারা ঘাটে আসে স্নান করতে ,তখন সে একটু অবাকই হল।
এবং অবাক হওয়ার অন্যতম কারণ লোকটার পোশাক। ফুল হাতা সাদা ফতুয়া আর ধুতি খালি পা। মাথায় লম্বা চুল গোঁফ দাড়ি। সমরেশের দেখে মনে হল অনেকটা রবি ঠাকুরের যুবাবস্থা। তবে লোকটা বেশ সুপুরুষ। মুখটা উজ্জ্বল। চোখ দুটো ভাসা ভাসা। তবে সে মুখে একটা বিষণ্নতা। সে বিষণ্নতা অশান্ত কিন্তু ক্লান্ত। তবে একটা দীপ্তি রয়েছে চোখে যাকে দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় লোকটা প্রত্যয়ী। সমরেশ কবি। পত্রিকায় লেখা বেরোয় না তবে ডায়েরীতে প্রায়শই বেরিয়ে পড়ে অবসর যাপনে। তাই হয়ত এত কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ।
তবে লোকটা কিন্তু অন্যরকম। একটা আকর্ষণ রয়েছে ওর অস্তিত্বে। সমরেশ বালতিটা সিঁড়ি থেকে তুলে ওপরে উঠতে লাগল।
আজ কত তারিখ ? - প্রশ্নটা ভেসে এল একদম ওপরের ধাপে বসে থাকা লোকটার থেকে। কণ্ঠস্বরে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। অনন্ত এই তিনটে শব্দে বোঝা গেল না।
১৫ই আগস্ট - সমরেশ উত্তর দিল।
লোকটা কেমন যেন সন্দেহের চোখে একবার সমরেশের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিল।
ঠিক বলছ ?
হম।
এবার সন্দেহটা সমরেশের হল। লোকটা কি পাগল? এই ভোরবেলা খালি পায়ে রবীন্দ্রনাথ সেজে গঙ্গার ঘাটে বসে তামাশা করছে ?
আপনি কোথায় থাকেন ? আসলে আমি এখানে রোজই আসি স্নান করতে। আপনাকে আগে কোনোদিন দেখিনি তাই…
থাকি? আপাতত কোথাও থাকি না। এই দেশের মাটিই তো আমার শয্যা - জন্ম থেকে মৃত্যু - এই মাটিই আমার দেশ আমার ঘর…
এবার সমরেশের আর সন্দেহ রইল না। লোকটা সত্যিই বিকারগ্রস্থ। যাই হোক নিষ্পাপ তামাশা ক্ষতিকারক নয়। আর তারপর আজ আবার স্বাধীনতার দিন।
সমরেশের ঠোঁটের কোণায় একটা সামান্য হাসির রেখা দেখা দিল। তা আপনার নামটা জানা নেই…
জ্যোতির্ময় সান্ন্যাল।
এখানকারই লোক না কোনো কাজে এসেছেন ?
জ্যোতির্ময় একবার চোখ তুলে তাকাল সমরেশের দিকে। একটু হেসে বলল - যশহর।
আদিবাস?
হ্যাঁ।
আর বর্তমান ?
জোড়াসাঁকো।
ভালো করে আর একবার তার মুখটা দেখে নিয়ে
সমরেশ বলল - চুঁচুড়ায় কী কোনো কাজে ?
চুঁচুড়া ?! জ্যোতির্ময় আকাশ থেকে গর্জে উঠল।
হ্যাঁ… সন্দেহ আছে ?
আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করার পরিকল্পনায় আছেন ? থাকলে ছেড়ে দিন। আমার বুদ্ধি বড় কম।
কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় ইনি একজন শিক্ষিত তামাশাপ্রেমী।
সে বুদ্ধির দৌড়ে আমিও উসেন বোল্টের নাম লেখা গেঞ্জি পড়ে দৌড়লেও একশ মিটারে একশ পঁচিশ বার হোঁচট খাই।
জ্যোতির্ময় হাসল। নামটা কিন্তু সার্থক।
তবে মানতে হবে আপনার কথায় আনন্দ আছে।
আপনার কথাটাও খুব একটা দুঃখদায়ক নয়।
আমি সমরেশ। সমরেশ সেন ।
আমার পরিচয় তো পেয়েছেন ।
হ্যাঁ পেয়েছি। তবে আপনার ব্যক্তিত্ব আরো কিছু কৌতূহল দাবী করে।
যেমন ?
যেমন আপনার পায়ে জুতো নেই। আপনার এই অদ্ভুত পোশাক…
অদ্ভুত ? আমার তো আপনার পোশাটাকেই অদ্ভুত মনে হচ্ছে মশাই !
হা… হা… হা… মনে হওয়াটা অস্বাভিক কিছু নয়।
আমার এই ভেজা দাঁড়কাকের মত অবস্থা সত্যিই অদ্ভুত।
দাঁড়কাক আর ময়ূরপুচ্ছের গল্পটা জানেন তো ?
নিতান্তই।
তা বেশ।
বললেন না তো এই রহস্যের ভেদ ?
আপনি মশাই বিলেত ফেরত নাকি ? ইংল্যান্ড আপনার দেশ না ভারতবর্ষ ? খদ্দর এখন গরুতেও চেনে…
হা...হা...হা...আজ স্বাধীনতার দিনে এসব আনন্দ নেহাতই উপভোগ্য… হা…হা…
লোকটা তার ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক ক্ষণ সমরেশের হাসিমাখা মুখটার দিকে।
স্বাধীনতা…হ্যাঁ… আমরা তো স্বাধীন… আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে...প্রত্যেকটা দিনই তো স্বাধীনতার উদযাপন! পরাধীনতা তো ভ্রম…মিথ্যে…না…ভারতবর্ষ মরে যায়নি আপনার মধ্যে!
আপনার কথাগুলো অদ্ভুত কিন্তু কেমন যেন নির্ভেজাল… শুনে মনে হয় এ আনন্দ মেকি নয় ...অন্তরের আনন্দ… এ আওয়াজ হৃদয়ের!
মৃদু হাসি তার ঠোঁটে। জয় হিন্দ ! জয় হিন্দ!
আমি তাহলে এগোই… বাড়ি ফিরে পুজো সারতে হবে ...আপনার সাথে আলাপ করে ভালো লাগল।
পরে আবার আলাপের অভিপ্রায় রইল। হেসে বলল সমরেশ।
আবার মিলিব মোরা স্বাধীন আকাশে ! বন্দে মা তরম !
বন্দে মা তরম !
জানেন আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছিল সমরেশ। পেছন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরে পেছন ফিরে তাকাল ।
জ্যোতির্ময় পেছন ঘুরে বসে আছে।
স্ত্রী গৃহে ?
হ্যাঁ। সাত মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা।
বাহ্। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনার স্ত্রী সন্তান এবং আপনার নির্মল ভবিষ্যত ।
ধন্যবাদ। আলতো হেসে বলল জ্যোতির্ময় আগের মতোই না ঘুরে। স্বাধীন ভারতে বড় হবে আমার ভারতী ! জানেন আমার খুব ইচ্ছে মেয়ে হোক আর তার নাম দেব ভারতী - মা ভারতী!
সমরেশ বুঝতে পারছিল না উপযুক্ত প্রত্যুত্তর ঠিক কী হওয়া উচিত। তবে এ আশা সুন্দর তাই তার প্রত্যুত্তরও আশাব্যঞ্জকই হল। একদম শেষ ধাপে উঠে সমরেশ আরো একবার ফিরে তাকাল। জ্যোতির্ময় নৌকায় উঠছে। ভোরের আলোয় ওর সাদা ফতুয়ার পিঠের ওপর তিন জায়গায় সমরেশ তিনটে কালচে লাল গর্ত দেখতে পেল। পাশে কিছু ছিটে।শুকিয়ে গেছে। এসব কী দেখছে সমরেশ !
জ্যোতির্ময় মাঝিকে ইশারা করল। নৌকো এগিয়ে চলল উদিত সূর্যের দিকে। হারিয়ে গেল জ্যোতির্ময়। সমরেশের কানে এল রেলির জন্য ব্যান্ড প্র্যাকটিস করছে। সমরেশের মনে পড়ে গেল আজ স্বাধীনতা দিবস।
তোমরা আমাদের মতো নয়
সার্বিক বন্যবাদ মুখার্জী
একদিন সব জঙ্গল ছিলো। বটের কোটরে আমি থাকতাম। পরপর সারি সারি তেঁতুল আর পিপুল গাছগুলো আমাদের ঘিরে থাকতো। একদিন মানুষ এলো।
হরেক রকম মানুষ, কেউ খুব লম্বা,কেউ মাঝারি, কেউ খুব বেঁটে। লম্বাদেরও ভাগ ছিলো পাঁচরকম। ওরা মারামারি করতে শুরু কোরলো। প্রত্যেকটা মানুষ প্রজাতি চেয়েছিলো; শুধু তারাই থাকবে। মানুষ শুধুই মানুষ চায়।
যে তুমি এখন পড়ছো; তুমি আমাদের মতন না। আমরাও আক্রমণ কোরি, কিন্তু; তোমরা পিছনে ছুঁড়ি মারো। তোমরা খাবারে বিষ দাও, তোমরা খাবারের টোপ দিয়ে, বড়শি গিঁথে ভেজে খাও। আজ এই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ প্রজাতি, হোমো সেপিয়েন্স।
আমরা তোমাদের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম, তোমরাও কথা দিয়েছিলে; প্রকৃতির নিয়ম মানবে। এই পৃথিবীর সব কিছু মানুষের নয়; তোমরা জানতে; মানতে চাও নি। তোমাদের সব বুদ্ধি পেটে। তলে তলে, তোমরা গাছেদের সাথে বন্ধুত্ব করলে;
পাখীদের সাথে, হনুমান বাঁদরদের সাথে, সাপেদের সাথে, আমাদের সাথে। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। তোমরা কথা রাখো নি। গাছ ছেড়ে একদিন গুহা খুঁজে নিলে। গাছ তখন আর তোমাদের বাড়ি নয়, তাই আমাদের বাড়ি কেটে, গুহা সাজাতে তোমরা দু'বার ভেবেছিলে।
প্রথমবার, গাছ কাটার উপায় ভেবেছিলে, দ্বিতীয় ভাবনায়, আমরা বাঁধা দিলে; আমাদের খুন করার পদ্ধতি ভেবেছিলে।
একদিন গুহাও ছেড়ে দিলে। সেদিন আমাদের জঙ্গল, গুহা কিছুই আর তোমাদের পছন্দ হচ্ছিলো না। জঙ্গল কেটে, মাঠ মুছে; বাড়ির পর বাড়ি বানালে। আমাদের খাবার, তোমাদের খাবার হয়ে গ্যালো। আমাদের খুন ক্যরা, তোমাদের কাছে 'শিকারের নেশা'।
বাঘ হয়ে গ্যালো পাপোষ, কুকুরেরা একটু
মানুষ ঘেঁষা; তাই তোমরা ওদের থাকতে দিলে।
টিয়া কাকাতুয়া তোমাদের ভাষা শিখছিলো; বেচারারা সব খাচার পাখি হয়ে গ্যালো। স্বাধীনতা হারিয়ে গ্যালো ওদের। মাছগুলো ছিলো রঙিন, দোষ বোলতে এটুকুই।
একদিন সব জঙ্গল ছিলো। জঙ্গল কেটে মাঠ। মাঠ মুছে দিয়ে, বাগান বাড়ি। সব মুছে দিয়ে ফ্ল্যাট। তোমরা একসাথে থাকবে বলেছিলে; তোমরা কথা দিয়েছিলে; এই পৃথিবীর নীল পদ্মে তোমরা লোভ করবে না, তোমরা কথা দিয়েছিলে, মৌচাকে তোমরা লোভ করবে না, তোমরা কথা
রাখো নি। একদিন জারোয়াদের দ্বীপে রিসোর্ট বানাতে তোমরা; আমি জানি।
এই মুহূর্তে; হোমো সেপিয়েন্স হোমো সেপিয়েন্স মারামারি করে। মাটি আর জলকে তোমরা ভাগ করেছো। খানিকটা করে মাটি'র একটা করে নাম। খন্ড মাটির গালভরা নাম 'দেশ'। এ দেশের তোমরা; ঐ দেশের মানুষদের শেষ করে দেবে। ও দেশের মানুষ; সে দেশের সব মানুষ মুছে দেবে।
এত লোভ কোরে, এত খুন কোরে; কি লাভ হোলো তবে? সেই তো টিকটিকির মতন, দেওয়াল ভাগ করে নিয়েছো, সেই তো কুকুরদের মতন পাড়া ভাগ করে নিয়েছো, সেই তো বাঘের মতন, জঙ্গল ভাগ করে নিয়েছো, সেই তো সাপের মতন, ইঁদুরের গর্তে ঢোকো, ইঁদুর মারো; ইঁদুর খাও
আর ওদের বাড়িকে নিজের বাড়িই বানিয়ে নাও। তোমাদের ঘরে টিকটিকি বেড়ে গেলে, যখন এক দেওয়ালে, অনেক টিকটিকি, ওরা খাবার নিয়ে মারামারি ক্যরে, তুমি কোথায় আলাদা? বীর হনুমানের বয়স হ্যলে, দল থেকে বের কোরে দ্যায় ওরা, তুমি কোথায় আলাদা?
এত কিছু কোরে, এত বুদ্ধি খাটিয়ে, তুমি তোমার পশুধর্ম ছেড়ে বেরোতে পারো নি, তবু তুমি আমার মতন নয়। আমরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে, বড়রা ছোটোদের খেয়ে নিই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয়, তোমরা সেসব পারো না। আমরা ভূমিকম্প শুরু হওয়ার দু'দিন আগে বুঝতে পারি,
তোমরা সেসব পারো না, আমরা গাছেদের সাথে কথা বোলতে পারি, তোমরা সেসব জানোই না। আমরা মারামারি কোরি, খুন কোরি না। আমরা দুর্বলকে আরও দুর্বল কোরি না, আমরা বোকা বানিয়ে কাউকে শেষ কোরি না। আমরা এই পৃথিবীতেই মরে যাবো একদিন,
আমরা মঙ্গলে যেতে পারিও না, সব শেষ করে পালিয়ে গিয়ে, আসলে কেউ তো জেতেও না।
একদিন ইংরেজ কিছু মানুষ; তোমাদের ভারতে থাকতে এসেছিলো। সব নিয়ে গ্যাছে চুরি কোরে, আলাদা কোরেছে তোমাদের।
একদিন তোমরা আমাদের জঙ্গলে থাকতে এসেছিলে, জঙ্গল কেটে মাঠ ঢেকে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট।
ওরা তোমাদের ধর্ম চুরি করেছে, তোমরা আমাদের গাছ
ওরা তোমাদের বিজ্ঞান চুরি করেছে, তোমরা আমাদের মাটি
ওরা তোমাদের কোহিনুর চুরি করেছে, তোমরা আমাদের খাবার
ওরা তোমাদের শান্তি চুরি করেছে, তোমরা আমাদের জল।
আমাদের সবার বিষ আছে, আমার মুখে, আমার বন্ধুর হূলে, আমার আর এক বন্ধু'র সারা গায়ে বিষ, তোমার বিষ তো নখে, তোমার বিষ মস্তিস্কে, তোমার বিষ দাঁতে - চোখে।
চাইলে আমরাও স্বাধীনতা'র লড়াই লড়তে পারি, এখনই, এই মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারি; তোমাদের। কিন্তু; আমরা পশু, আমরা ক্ষমা করতে করতে মরে যেতে পারি, দুর্বলকে খুন করি না।
মানুষ তুই দুর্বল, তুই কালা তুই অন্ধ তুই বোবা তাই আমরাই আজ অবলা, আমাদের থেকে সব কেড়েছিস
অন্তত একটু মাটি একটু জল একটু বাতাস একটু ফল,
পারলে আমাদের থাকতে দিস
তোদের দোকানে বাজারে ঘরে বাথরুমে শুধুই বিষ।
আজ; ইংরেজ চলে গ্যাছে, তুই কনফিউস; স্বাধীনতা আদৌ পেয়েছিস? খায়? মাথায় দ্যায়? কবিতায় লিখতে হয়? যাপনে ছাপতে হয়?
আজ; প্রকৃতি স্বাধীনতা চায়। কাল এই পৃথিবী থেকে তোদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে, ঝড়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে, আগুণে পুড়িয়ে দেওয়া হবে, গরমে গলিয়ে দেওয়া হবে, ঠান্ডায় জমিয়ে দেওয়া হবে, বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হবে, সুনামীতে ডুবিয়ে দেওয়া হবে।
ইংরেজরা নিজেদের পায়ে; নিজেরাই কুড়ুল মেরেছিলো সেদিন। বুলেটে গরুর মাংস পুরেছিলো।
তোরাও যে ডালে বসে আছিস, সেই ডাল কাটছিস রোজ।
স্বাধীনতা'র লড়াই শুরু হয়ে গ্যাছে হে মানুষ।
হে মানুষ, এই পৃথিবীর সবটায় অধিকার আছে আমাদেরও। এই পৃথিবীতে অধিকার আছে আমাদেরই।
হে মানুষ, আমাদের মাটি ফেরত দাও।
আমরা তোমায় চাইছি না আর, দেখি; কতদিন থাকতে পারো,
"ও মূর্খ কালিদাস, পৃথিবী ছাড়ো"।
পাখিজন্ম ও স্বাধীনতা
সুকান্ত দাস
পাখিজন্মের স্বাদ আমার ঐচ্ছিক ছিল। ছোটবেলায় মায়ের থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। মনে হত পৃথিবীটা বুঝি ছোট । কোণাকুনি গেলেই পৌঁছে যাব তীরবন্দি কোন দ্বীপে, যেখানে মা বসে আছে। তখনও কোথাও নৌকা ভীড় করেনি। খোলা উঠোন বেয়ে আগমনির মতো গান, কে বা চালিয়ে দিয়েছে! পর্দাগুলো হওয়া পেয়ে দুলতে থাকে। মা চুলে জুঁই ফুলের তেল দিচ্ছে বহিদিন পর। বড় হয়ে দেখি প্রেমিকার চুলে মায়ের দেওয়া তেল লেগে আছে।
বড় হয়েছি বুঝে উঠতেই যুদ্ধ বেঁধে যায়। প্রতিদিন তার কিছু যুক্তি পেশ করি। আমাদের ভেতরেই সবচে' বড় পানিপথ। ভোরবেলাকার স্বপ্নের মতো নেমে পড়ি শীতার্ত দিনগুলিতে। অসংখ্য হাততালি পরবর্তী গন্তব্য বাতলে দেয়। ইশারায় স্বৈরাচারিতা থাকে। এই সংজ্ঞাও কিছুটা ভুল। স্বাধীনতার ভেতর জেগে আছে বুনো পার্থেনিয়াম। কেন এত উজান আর মাদকতা?প্রতি মুহূর্তেই সন্দেহের জন্ম হয়। তবে কি লড়াই জিইয়ে বাঁচা নাকি নজরমিনার এদিকেই ঘোরানো আছে? একটা যুদ্ধ নিউক্লিয়াসের শিকল বিক্রিয়ার মতো, চলতে থাকে। আমাদের ভেতর পরোক্ষ সৈনিকের বাস। এমনিতে কোথাও হল্লা নেই। জল্পনা হয়। দেশভক্তি বিলি করা হয় গণতন্ত্র বুঝতে চাইবার আগে। কিছু অভিধান থাকে যাদের শব্দকোষ এক, জোর করে উঠিয়ে রাখা। ইন্দ্রিয়রা সব জানে তবুও সন্দেহ। নিজেকে ঘিরে নিজের। এভাবেই বাতাসে বয়ে চলে আমার দিন গণনা। পাখিজন্মের ভেতরই বুঝি স্বাধীনতার স্বাদ জড়িয়ে ছিল।
ছবি:google
No comments:
Post a Comment